বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

বায়োফ্লক কি? বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার উপায়

কৃষি প্রযুক্তি বায়োফ্লক
বেকারত্বের চাপে মানুষ বিকল্প কর্মসংস্থানের দিকে ঝুকছে। আর বায়োফ্লক সেই সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচন করে দিয়েছে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার সম্ভাবনা, সুবিধা, অসুবিধা এবং খরচ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরন নিয়ে আজকের পোষ্ট।

 

খুব বেশী দিন হয়নি Biofloc নামটা আমরা শুনছি। দিন দিন মানুষ বাড়ছে জমির উপর চাপ বাড়ছে।ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর কেটে মাছ চাষ করার কথা এখন ভুলে যান।কারন বায়োফ্লক এমন একটা চাষ পদ্ধতি যেখানে মাছ চাষের জন্য পুকুরের প্রয়োজন হয় না।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

শুধুমাত্র কিছু পানি ধরে রাখা যায় এমন কোন পাত্র, চৌবাচ্চা,হাতে তৈরি ভ্রাম্যমান পানির ট্যাংক আর সামান্য কিছু সরঞ্জামাদি দিয়ে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়।
সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো Biofloc প্রযুক্তি অনুয়ায়ী উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছের মল মূত্র ও অব্যবহৃত খাদ্য থেকে নিঃসৃত এমোনিয়াকে ব্যবহার করে অনুজীব প্রোটিন তৈরি করে। আর এই অনুজীব প্রোটিন গুলো মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ফলে মাছের খাদ্য কেনা বাবদ অর্থ বেচে যায়।

বায়োফ্লক কি

বায়োফ্লক কথাটির শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায়, বায়ো অর্থ জীবন আর ফ্লক অর্থ হলো ভাসমান কনার সমষ্টি। মূলত একোয়াকালচার প্রযুক্তির সর্বশেষ সংস্করন হচ্ছে এই বায়োফ্লক পদ্ধতি।
মাছের মল মূত্রের সাথে অব্যবহ্রত খাদ্য নিঃসৃত এমোনিয়ার দ্বারা যে ব্যাকটেরিয়া ও শৈবাল তৈরি হয় তা পানিতে উৎপন্ন হওয়া নাইট্রোজেন গঠিত জৈব বর্জ্যকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হতে না দিয়ে নিজেদের বংশ বাড়ায় এবং এটিকেই ফ্লক বলে।
এসব ফ্লকে প্রচুর উপাদান থাকে, যা মাছের পুষ্টির যোগান দেয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে প্রোবায়োটিক কালচারের মাধ্যমে ফ্লক তৈরি করা হয়।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

 

যার ফলে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন করে পুকুর খননের প্রয়োজন পড়বে না। পানি ধরে রাখতে সক্ষম এমন যে কোন জায়গায় কিছু কলাকৌশল আর প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ চাষ করা সম্ভব।
আরোও পড়ুন,

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

কৃত্রিম ভাবে পানিতে জন্ম নেওয়া অনুজীব এবং শৈবালের আস্তরন পানি থেকে নাইট্রোজ্রন শোষন করে নেয়, পানিতে এমোনিয়ার পরিমান নিয়ন্ত্রন করে এবং এর প্রোটিন সমৃদ্ধ উপাদান গুলো মাছ খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। এটাই হচ্ছে Biofloc পদ্ধতিতে মাছ চাষ এর মূলমন্ত্র।
এই প্রযুক্তি প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে পানির খাদ্যগুন বৃদ্ধি করে। এছাড়াও রোগ সৃ‌ষ্টিকারি ক্ষতিকর জীবানু নিয়ন্ত্রণ করে বায়োসিকিউরিটি প্রদান করে। এমনকি বায়োফ্লক পদ্ধতিতে বিদ্যামান ক্ষতিকর এমোনিয়া বাইরে থেকে সরবরাহ করা কার্বন কে ব্যবহার করে অনুজীব আমিষ তৈরী করে।

Biofloc প্রযুক্তি অনুয়ায়ী উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছের মল মূত্র ও অব্যবহৃত খাদ্য থেকে নিঃসৃত এমোনিয়াকে ব্যবহার করে অনুজীব প্রোটিন তৈরি করে।
এই অনুজীব প্রোটিন গুলো মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।ফলে মাছের জন্য কেনা খাদ্য সরবরাহ করার প্রয়োজন পড়ে না।
এই পদ্ধতিতে অল্প জমি আর অল্প পানিতেই অল্প খরচে অধিক পরিমানে মাছ উৎপাদন সম্ভব। জমির স্বল্পতার বাধা কাটিয়ে যেকোন জায়গায় এমনকি ঘরের ভিতরেও মাছ চাষ করা সম্ভব।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের সুবিধা

বায়োফ্লক পদ্ধতির অনেকগুলো সুবিধার মধ্যে অন্যতম হলো, জমি স্বল্পতার সমস্য দূর করে ঘরে বাইরে যে কোন জায়গায় মাছ চাষ করার সুযোগ।
একটি পুকুরের সমপরিমান জায়গায় প্রায় ২০ গুন বেশী মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। যার ফলে সেভাবে পুকুর বা ডোবার উপর নির্ভরশীলতা কমবে।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

 

এই পদ্ধতিতে মাছের খাবারের খরচ ৩০ শতাংশ বেচে যায়।এটি একটি প্রাকৃতিক ও পরিবেশ বান্ধব প্রক্রিয়া। যেখানে উপকারী অনুজীব গুলো সংরক্ষন করা হয়।
Biofloc পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার সুবিধা হলো এই পদ্ধতিতে মাছের বৃদ্ধি দ্রুততার সাথে ঘটে। ফলে অল্প সময়ে অনেক বেশী উৎপাদন করা সম্ভব।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার অসুবিধা সমূহ

নাইট্রোজেন ও কার্বনের তারতম্য বুঝতে না পারলে এই পদ্ধতি সম্পুর্ন অকার্যকর।
এই পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য সার্বক্ষনিক বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে।
সবকিছু মেনে চাষ করতে পারলে অবশ্যই লাভ হবে তবে যেকোন ক্ষতি হবে বড় ধরনের ক্ষতি।
এটি পরিচালনা করতে গেলে নুন্যতম পক্ষে কিছু টেকনিক্যাল জ্ঞান থাকা আবশ্যক। যা পানির রাসায়নিক অবস্থা বুঝতে সাহায্যে করবে।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে কি কি মাছ চাষ করা যায়

প্রথমত তেলাপিয়া, শিং, মাগুর, চিংড়ীসহ আরোও কিছু প্রজাতির মাছ বায়োফ্লক পদ্ধতিতে চাষ করা লাভজনক।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে এখন পর্যন্ত শুধু তেলাপিয়া এবং চিংড়ী মাছই চাষ করা হয়। তবে প্রথমবস্থায় সবচেয়ে নিরাপদ এবং জনপ্রিয় হলো চিংড়ি মাছ।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে কি কি লাগে

Biofloc পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করার জন্য প্রথমে প্রয়োজন পানি ধরে রাখার মতো জায়গা, সেটা চৌবাচ্চা বা ট্যাংক বা হাউজ হতে পারে। হতে পারে কোন পতিত জায়গা বা ঘরের ভিতরে।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে কিছু ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ও মাছের খাদ্য দরকার হয়। সেগুলো হলো টিডিএস মিটার, পি এইচ মিটার, এমোনিয়া টেস্ট কিট, বৈদ্যুতিক মটর, বিদ্যুৎ, মাছের খাবার, প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি।
যেকোন অবস্থানে সামান্য কয়েক ফুট জায়গা দিয়েই বায়োফ্লক পদ্ধতি তে মাছ চাষ করা শুরু করা যেতে পারে। তবে প্রথম শুরুর জন্য কিছু যন্ত্রপাতি অবশ্য লাগবে।

 

বায়োফ্লকের খরচ ও লাভের হিসাব

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে কি পরিমান লাভ হতে পারে এটা অনেক গুলো শর্তের উপর নির্ভর করবে। প্রথম শর্ত হলো বায়োফ্লক সম্পর্কে থিউরিটিক্যাল জ্ঞান থাকতে হবে। কারন এটি এক ধরনের জৈবিক প্রক্রিয়া।
স্পষ্ট জ্ঞান ছাড়া Biofloc থেকে লাভ আশা করা মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। আজ আমরা ওতো গভীরে যাবো না।সঠিক ভাবে পরিচালনা করতে পারলে একটি বায়োফ্লকের প্রজেক্টের খরচ ও লাভের একটা সুস্পষ্ট ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে অবকাঠামোগত খরচ

প্রথমেই ধরে নিই যে আমরা ১০ টি ট্যাংকে শিং মাছের চাষ করবো। সোজা খরচের খাতায় চলে আসুন ১০টি ট্যাংক বানাতে খরচ হবে প্রায় ৪ লাখ টাকা। ট্যাংক গুলো ঢেকে রাখার জন্য ১০ টি আধা পাকা শেড নির্মানের ব্যয় ৩ লাখ টাকা। ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতিসহ আনুষাঙ্গিক খরচ আরোও ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তাহলে ১০ টি ট্যাংকের একটি বায়োফ্লক প্রজেক্টের অবকাঠামোগত খরচ দাঁড়ায় আনুমানিক ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে উৎপাদন খরচ

সবে তো অবকাঠামো নির্মান হলো এবার আসুন উৎপাদন খরচের দিকে তাকাই,প্রথমেই ১০ টি ট্যাংকে লালন পালনের জন্য ২ লাখ ২০ হাজার টাকার শিং মাছের পোনা কিনতে হবে। এবার শিং মাছের পোনাগুলো হিসাব অনুযায়ী ট্যাংকে ছেড়ে দিন।
পুরা ১ টা বছর এদের লালন পালন করতে হবে যার লেবার বিল ধরে নিলাম ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ইউটিলিটি বিল ধরে নিই ৮০ হাজার টাকা। মাছের প্রোবায়োটিক ও খাদ্য বাবদ খরচ ধরি ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। সর্বসাকূল্যে প্রথম বছরে আপনার সর্বমোট ব্যয় দাড়ালো ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তাহলে ১০ টি ট্যাংকে ১ বছর মাছ লালন পালন করতে খরচ হচ্ছে আনুমানিক ১০ লাখ ১৫ হাজার টাকা।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের আয় ব্যয়ের হিসাব

এবার আসেন মাছের উৎপাদন ও তার বিক্রয় মূল্যের হিসাবটা মিলিয়ে নিই। খুব কম করে হলেও প্রতিটি ট্যাংকে ১ বছরের মাথায় প্রায় ৩৫০ কেজি শিং মাছ পাওয়া যাবে। বিভিন্ন কারনে উৎপাদনে হেরফের হতে পারে তবে আমরা একটা ধারনা নেওয়ার জন্য মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছি।
১০ টি ট্যাংকের প্রতিটিতে ৩৫০ কেজি মাছ অর্থাৎ ৩৫০০ কেজি শিং মাছ আপনি বায়োফ্লক পদ্ধতিতে উৎপাদন করেছেন যার বাজার মূল্য আনুমানিক প্রতি কেজি ৩০০ টাকা। তাহলে আপনি প্রথম বছরে ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ করে মাছ বিক্রি করলেন ১৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে লাভ কেমন

হ্যা,প্রথম বছরে আপনার লাভ মাত্র ১৫ হাজার টাকা। হতাশ হবেন না এবার আসেন আসল হিসাবে আসি প্রথম বছরে আপনি যে অবকাঠামোগত ব্যয়টা করেছেন ২য় চালানে যখন আপনি শিং মাছের পোনা ছাড়বেন তখন কিন্তু সেই অবকাঠামোগত ব্যয়টা দ্বিতীয়বার করার দরকার হচ্ছে না অর্থাৎ ১০ পানির ট্যাংক,শেড,সরঞ্জামাদি আপনার তো কেনাই আছে ।
এবার দ্বিতীয় বছরে ১০ টি ট্যাংকে শিং মাছ ১ বছর লালন পালন করতে আপনার খরচ হবে মাত্র ১০ লাখ ১৫ হাজার টাকা আর দ্বিতীয় বছর শেষে আপনি ১০ টি ট্যাংক থেকে মাছ বিক্রি করবেন ১৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তাহলে দ্বিতীয় বছরে কত টাকা লাভ হলো যোগ বিয়োগ টা আপনি নিজের হাতেই করে দেখুন।
এবার আপনার সুবিধা অনুযায়ী মাছের জাত বাছাই করে বানিজ্যিক ভাবে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করতে পারেন। বিস্তারিত গাইডলাইন অনলাইনে বিভিন্ন রিসোর্স থেকে সংগ্রহ করে নিজেই ঘুচিয়ে নিতে পারেন নিজের বেকারত্বের বোঝা।
বায়োফ্লক সম্পর্কে আরোও বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন।

 

শেষকথা

বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ একটি সহজ ও কার্যকর উপায়। উঠান, ঘর বা সামান্য পতিত জায়গাতে অল্প পুজিতে বায়োফ্লক শুরু করা যায়।